মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (১৭৬২-১৮১৯)

0
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত ছিলেন মৃত্যু বিদ্যালঙ্কার। রামমোহন-পূর্ব যুগের স্মরণীয় বাঙালিদের মধ্যে তাঁর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয়। বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রকৃত স্রষ্টারূপে মৃত্যুঞ্জয়কেই সম্মান দেওয়া উচিত। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের যে পণ্ডিতদের চেষ্টায় বাংলা গদ্য সাহিত্য ভিত্তি লাভ করেমৃত্যুঞ্জয় তাঁদের মধ্যে রচিত গ্রন্থের সংখ্যাধিক্যে এবং ভাষার শিল্পরূপের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী ছিলেন। সহমরণ প্রথার বিরোধী হিসেবে তিনি যে উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেকালের পক্ষে তা ছিল বিস্ময়কর

উইলিয়াম কেরি ও মৃত্যুঞ্জয় [ছবি- ইন্টারনেট]




গ্রন্থাবলী ও ভাষারীতি

মৃত্যুঞ্জয় সমকালীন লেখকদের তুলনায় অনেক বেশি বই লিখেছিলেন।

১. বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২) 
২. হিতোপদেশ' (১৮০৮) 
. ‘রাজাবলি (১৮০৮) 
৪. প্রবোধচন্দ্রিকা’ (রচনা আনুমানিক ১৮১৩)  
৫. ‘বেদান্তচন্দ্রিকা (১৮১৭)



মৃত্যুঞ্জয়ের বত্রিশ সিংহাসন’ এবং 'হিতোপদেশসংস্কৃতের অনুবাদ মাত্র। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এক্ষেত্রে মৃত্যুঞ্জয়ের মৌলিকতা কিছু নেই। কিন্তু গোলোকনাথের হিতোপদেশ প্রকাশের কয়েক বছর পর তিনি একই বিষয় নিয়ে লিখলেন--  সম্ভবত নিজ ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ ছিলেন বলেই। রাজাবলি’ বইয়ের বিষয়বস্তু হুবহু কোনো বই থেকে অনূদিত নয়। নানা স্থান থেকে সংগৃহীত। কলির আরম্ভ থেকে ইংরেজ-অধিকার পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাজা ও সম্রাটদের কথা তিনি এই বইয়ে বলেছেন। ধারাবাহিক ইতিহাস সংকলনের এই প্রথম প্রচেষ্টা লক্ষ করবার মত। প্রবোধচন্দ্রিকা'র মধ্যে নানা শাস্ত্রকথানীতিকথাব্যাকরণঅলঙ্কারছন্দ প্রভৃতি প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নানা গালগল্পরূপকথা সঙ্কলিত হয়েছে। এদের কিছু কিছু অন্য বই থেকে সংগৃহীত। কিন্তু পরিকল্পনাগ্রন্থনা ও রচনা মৃত্যুঞ্জয়ের নিজস্ব। বইটি দীর্ঘকাল পাঠ্যপুস্তক রূপে সেকালের নানা বিদ্যালয়ে সমাদৃত হয়েছে।

বেদান্তচন্দ্রিকা রামমোহনের বেদান্তগ্রন্থের প্রতিবাদ। মৃতুঞ্জয়ের দার্শনিক জ্ঞানগভীর মনীষা ও বিতর্ক-কুশলতার সুন্দর নিদর্শন এই রচনা। মৃত্যুঞ্জয়ের ভাষা অত্যন্ত উৎকট ও সংস্কৃতানুসারী বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। প্রবোধচন্দ্রিকা'র ‘কোকিলকুলকলালাপবাচাল যে মলয়াচলানিল সে উচ্ছলচ্ছীকরাত্যচ্ছনির্কররাস্তঃকণাচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে।”— এই বাকাটির উদাহরণে মৃত্যুঞ্জয়ের গদ্যকে দূরূহ এবং অপাঠ্য বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তা ঠিক নয়। প্রবোধচন্দ্রিকা'র কোনো কোনো স্থলে মূলানুসরণ করতে গিয়ে দূরূহতা এসেছে ঠিকই কিন্তু সাধারণভাবে মৃত্যুঞ্জয়ের ভাষা সম্বন্ধে এ অভিযোগ গ্রাহ্য নয়। তার কথ্য ভাষার নমুনা উদ্ধৃত হল :

মোরা চাষ করিব ফসল পাবোরাজার রাজস্ব দিয়া যা থাকে তাহাতেই বছর শুদ্ধ অন্ন করিয়া খাবোছেলেপিলাগুনি পুষিব। যে বছর শুকা হাজাতে কিছু খন্দ না হয়সে বছর বড় দুঃখে দিন কাটিকেবল উড়ি ধানের মুড়ী ও মটর মসূর শাক পাত শামুখ গুগুলি সিজাইয়া খাইয়া বাঁচি।

মৃত্যুঞ্জয়ের পণ্ডিতী গদ্যের নমুনা

যে সিংহাসনে কোটি কোটি লক্ষ স্বর্ণদাতারা বসিতেন সেই সিংহাসনের মুষ্টিমাত্র ভিক্ষার্থী অনায়াসে বসিল। যে সিংহাসনে বিবিধ প্রকার রত্নালঙ্কারধারিরা বসিতেন সে সিংহাসনে ভক্মবিভূষিতসর্বাঙ্গ কুযোগী বসিল। যে সিংহাসনে অমূল্য কিরীটধারী রাজারা বসিতেন সেই সিংহাসনে জটাধারী বসিল।

এই উভয় রীতির ভাষাই যে পাকা হাতের লেখা—দুর্বল কলমের কম্পন যে এদের মধ্যে কোথাও নেই একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

মৃত্যুঞ্জয়ের ভাষাবিষয়ক কৃতিত্ব বর্ণনা করে প্রমথ চৌধুরী যে মন্তব্য করেছেন তাকে যথার্থ বলে স্বীকার করার কারণ আছে-
মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার কালের হিসাব ক্ষমতার হিসাব-- দুই হিসাবেই এই শ্রেণীর লেখকদিগের অগ্রগণ্য। ..... তিনি একদিকে যেমন সাধু ভাষার আদি লেখক-- অপরদিকে তিনি তেমনি চলতি ভাষারও আদর্শ লেখক। -- ইহা যে খাঁটি বাঙ্গালা সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। এ ভাষা সজীব সতেজ সরল স্বচ্ছন্দ ও সরস। ইহার গতি মুক্ত ইহার শরীরে লেশমাত্র জড়তা নাই এবং এ ভাষা যে সাহিত্য রচনার উপযোগী উপরোক্ত নমুনাই তাহার প্রমাণ।

ছবি- উইকিসংকলন
মৃত্যুঞ্জয়ের ভাষার মধ্যে একটি অনুসন্ধান ও ক্রমবিকাশের ভাব লক্ষ করা যায়। ‘বত্রিশ সিংহাসন'-এর ভাষার তুলনায় 'রাজাবলি'-প্রবোধচন্দ্রিকা'র ভাষা অনেক বেশি শিল্পগুণান্বিত। তাছাড়া মৃত্যুঞ্জয় সুনিশ্চিতভাবে বুঝেছিলেন দুটি উৎসেই বাংলা গদ্যের আদর্শ খুঁজতে হবে। লোক-উৎস এবং সংস্কৃত ভাষারীতিউভয় রীতিতেই তিনি নৈপুণ্য অর্জন করেছিলেন। কথ্য-রীতির সম্ভাবনাকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন—সে ভাষার নিদর্শনকে স্থান দিয়েছিলেন গ্রন্থমধ্যে। তবে সংস্কৃত রীতির গদ্যভঙ্গিটি তিনি অনেকখানি বেঁধে দিয়েছিলেন।



রামমোহন গদ্য সাহিত্যে প্রবেশের পূর্বে মৃত্যুঞ্জয় চারখানি বই লিখেছেন। রামমোহনের গদ্য অপেক্ষা তাঁর গদ্য অনেক বেশি সহজসাবলীল। রামমোহনের ভাষা পুরাতন সংস্কৃত টীকাভাষ্যের আদর্শে গঠিত। সে ভাষা সর্বদা পূর্বপক্ষকে প্রদক্ষিণ করে চলে। আবার কখনো ইংরেজি রীতি অনুসারী। তার তুলনায় মৃত্যুঞ্জয়ের ভাষা অনেক সজীব। বিষয়ের কথা ছেড়ে দিলে-- শুধু ভাষারীতির ক্রমবিকাশের দিক থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের ধারায় বিদ্যাসাগরকে স্থাপন করে চলে। বাংলা গদ্যরীতির রাজপথটি মৃত্যুঞ্জয় থেকে শুরু হয়ে বিদ্যাসাগরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
-----------------------------------------------------------





-----------------------------------------------------------
সাহায্য- ক্ষেত্রগুপ্ত
-----------------------------------------------------------

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top