উইলিয়াম কেরি (১৭৬১ - ১৮৩৪)

0

উইলিয়াম কেরি (১৭৬১ - ১৮৩৪)





বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে কেরী সাহেবের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথমে বাংলা গদ্য ভাষার চর্চা ধর্ম-প্রচারকরূপ লক্ষ্যের উপায় হিসেবে তিনি প্রহণ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উপায়ের গৌণ ভূমিকায় না থেকে লক্ষ্যের মুখ্য ভূমিকা সে অধিকার করে বসল। শ্রীরামপুর থেকে কেরি আগেই বাইবেলের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিভাগীয় প্রধান রূপে তিনি পণ্ডিত-মুনসিদের দ্বারা বই লিখিয়ে মুদ্রণের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। পুরস্কারাদি বিতরণ করে লেখকদের উৎসাহকে সজীব রাখার ব্যবস্থাও করলেন। তিনি নিজেও প্রত্যক্ষভাবে গ্রন্থকার রূপে অবতীর্ণ হলেন।

উইলিয়াম কেরি [ছবি- উইকিপিডিয়া]


গ্রন্থাবলী ও কৃতিত্ব


কলেজ থেকে তাঁর দুটি বই প্রকাশিত হয় থোপকথন (Dialogue, ১৮০১) এবং ইতিহাসমালা’ (১৮১২)। গ্রস্থ দুটির ভাষা ও ভঙ্গির পরিচয় নিলে বিস্মিত হতে হয়।

থোপকথন’ গ্রন্থটি ইংরেজ সিভিলিয়ানদের এ দেশের কথ্য ভাষার বিচিত্র ভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত করবার উদ্দেশ্যে সঙ্কলিত। প্রন্থটিতে মোট একত্রিশটি অধ্যায় আছেঅধ্যায়গুলিতে মজুরের কথাবার্তাঘটকালিহাটের বিষয়, স্ত্রীলোকের হাট করামাইয়া কোন্দলজমিদার-রায়ত কথা প্রভৃতি সমাজের সন্তাবা সকল স্তরের সাধারণ লোকের কথোপকথনের উদাহরণ রয়েছে। ফলে গ্রহটিতে সমকালীন সমাজের বাস্তব জীবনযাত্রার ছবি অনেকানি ধরা পড়েছে। এর ভাষা কম বিস্ময়ের সঞ্চার করে না। এই রচনাতেই প্রথম কৃত্রিম সংস্কৃতানুগ ভাষার স্থলে যথার্থ কথ্য ভাষা স্থান পেয়েছে। যেমন

আয় টে সকাল কবে চল সুতো না বিকেলে তো নুন তেল বেসাতি পেতে হবে না ও টে বুন সে দিন কলঘাটার হাটে গিয়াছিলাম তাহাতে দেখিয়াছি সূতার কপালে আগুন লাগিয়াছে। পোড়া কপালে তাঁতি বলে কি আ করে সূতাখান। সে সকল সূতা আমি এক কাহন বেচেচি টে

বাংলা প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহারে এই ভাষা বেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই গ্রন্থের পরিকল্পনা এবং সম্পাদনার কাজ কেরিই করেছিলেন। গ্রহটির প্রকৃত রচয়িতাদের সম্পর্কে তিনি ভূমিকায় লিখেছিলেন,

‘That the work might be as complete as possible, I have employed some sensible natives to compose dialogues upon subject a domestic nature, and to give them precisely in the natural style of the persons supposed to be speakers.’

নিজে রচয়িতা না হলেও কেরি পরিকল্পনার ব্যাপারে ভাষা ও বিষয় দুদিক থেকেই যে সাহসবিচক্ষণতা ও বিবেচনাবুদ্ধির পবিচ দিয়েছেন যে কোনো পাদ্রীর পক্ষে তা বিস্ময়কর। কিন্তু গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে কার রচনা সে প্রশ্নের সমাধান করা প্রয়োজন। সমকালে কলেজের পণ্ডিত-মুনসিরা যেরূপ গদ্য লিখতে তাতে মনে হয় না মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ছাড়া অন্য কেউ এরূপ লিখতে সক্ষম ছিলেন। তাঁর নিজের নামে প্রকাশিত গ্রন্থগুলিতেও কথোপকথনের ভাষায় বহুক্ষেত্রে প্রাণবন্ত কথ্যরীতির অনুসরণ লক্ষ করা যায়।

কেরির ইতিহাসমালা আসলে ইতিহাস নয়প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সূত্র থেকে সঙ্কলিত কতকগুলি গল্পের সমষ্টি। বাংলা লৌকিক কাহিনীর ভাণ্ডার থেকেও অনেক লেখা গ্রহণ করা হয়েছিল। নিদর্শন

এক রাজার অতি সুন্দরী কন্যা কিন্তু সে হরিণীবদনা জন্মিয়াছিল রাজ তাহাতে সদা ভাবিত কি ক্রমে বিবাহ হইবেক স্বীকার কেহ করে না এই মতে প্রায় বার তের বৎসর বয়ক্রম হইল।

ইতিহাসমালার ভাষা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রাথমিক যুগের ভাষা অপেক্ষা অনেক উন্নত এবং গদ্য রচনার একটা স্টাইলও এতে লক্ষিত হয়। গল্পগুলির অধিকাংশই ব্যঙ্গপ্রধানবত্রিশ সিংহাসনের টুকরা টুকরা গল্পের মত। বাইবেল অনুবাদের আড়ষ্টতা তিনি তে বর্জন করেছেন। অবশ্য কথোপকথনের সবেগ সাবলীলতা তে নেই। কেরী সম্ভবত এক্ষেত্রে সম্পাদক ও সঙ্কলকর্তালেখক নন।

প্রধানত সম্পাদকপরিকল্পনা ও প্রেরণার উৎস হিসেবে বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের ভিত্তি স্থাপনে কেরির অতুলনীয় দানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।










-------------------------------------------------------
সাহায্য- ক্ষেত্রগুপ্ত
-------------------------------------------------------


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top