রামমোহন রায় (১৭৭৪ – ১৮৩৩ খ্রি.)

সাময়িক পত্র পরিচালনা
প্রাবন্ধিক রামমোহন
রামমোহন
প্রায় ত্ৰিশখানা বাংলা গ্রন্থ রচনা করেন, এ ছাড়া বহু ইংরেজি ও সংস্কৃত
গ্রন্থেরও তিনি রচয়িতা। রামমোহনের ব্যক্তিত্বের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তাঁর
রচনাবলীর মধ্যে তারই প্রতিফলন । লক্ষ করা যায় তাঁর প্রবন্ধ-গ্রন্থাবলী চিন্তার
স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্তের মৌলিকতা যেমন ধরে রেখেছে তেমনি রামমোহনের সমগ্র
ব্যক্তিত্বকেও যেন প্রকাশ করেছে। তিনি ধর্মে প্রাচ্যের ভাবানুগামী হলেও সামাজিক ও
ব্যক্তিগত আচার, শিক্ষাগত, সামাজিক
ও রাষ্ট্রনীতি মতবাদে পাশ্চাত্যানুসারী ; জ্ঞানমার্গী
বৈদান্তিক হয়েও বিষয়কর্মে সু-অভিজ্ঞ।
ভাষারীতি
রামমোহনের
হাতে বাংলা গদ্যভাষা প্রথম আভিজাত্য লাভ করল। এর পূর্বে স্কুল-কলেজে পাঠ্য করবার
জন্যই গদ্যে নানাবিধ পশুপক্ষীর কাহিনি, ভূগোল-পরিচয় বা বালসেব্য সেকালীন
উপকথা সঙ্কলিত হত। রামমোহন বাংলা শিশুগদ্যে বেদান্ত-উপনিষদের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা
আরম্ভ করেন। প্রাচীন শাস্ত্রের প্রমাণে এবং যুক্তির প্রবলতায়, তীক্ষ্ণ বিতর্কে তাঁর গদ্য এক কঠিন পৌরুষ লাভ করল। বাংলা গদ্যে যে
গুরুগম্ভীর আলোচনা সম্ভব তিনিই প্রথম তা দেখিয়ে দিলেন। ফলে বাংলা শিশুগদ্য কিছু
নুয়ে পড়ল, পদচারণায় কিছু স্খলন এবং অস্বাচ্ছন্দ্য দেখা
দিল। দুরূহ বিষয়বস্তুর আলোচনার
সম্ভাবনা রামমোহনের পূর্বে কেউ দেখতে পাননি। তাই রামমোহনের গদ্য যে সরল ছিল না এজন্য তাকে অভিযুক্ত করা চলে না। তবে পরবর্তী অনেকের তুলনায় তিনি
ভাষাকে জড়ত্ব ও অকারণ কাঠিন্য থেকে অনেকটা মুক্ত করেছিলেন।
সব
দিক দিয়ে বিচার করলে রামমোহন রায়কে বাংলা ভাষার প্রথম প্রাবন্ধিক (চিন্তা প্রধান
প্রবন্ধের রচয়িতা) বলে অবশ্যই অভিহিত করা যায়।
রামমোহনের
রচনা থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করলে তাঁর ভাষার পৌরুষ এবং যুক্তিপ্রাণতার
পরিচয় যেমন মিলবে তেমনি দেখা যাবে পদবিন্যাসের ক্ষেত্রেও তিনি বাংলা ভাষার স্বরূপ
ধর্মকে অনেকখানি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। রামমোহন খ্রিস্টীয় মিশনারীদের ধর্মপ্রচারের বিরুদ্ধাচরণ করে লিখেছেন,
শতার্দ্ধ বৎসর হইতে অধিক কাল এ-দেশে ইংরেজের অধিকার হইয়াছে তাহাতে প্রথম ত্রিশ বৎসরে তাহাদের বাক্যের ও ব্যবহারের দ্বারা ইহা সর্ব্বত্র বিখ্যাত ছিল যে কাহারো ধর্মের সহিত বিপক্ষতাচারণ করেন না.... কিন্তু ইদানীন্তন বিশ বৎসর হইল কতক ব্যক্তি ইংরেজ যাহারা মিশনারী নামে বিখ্যাত হিন্দু ও মোছলমানকে ব্যক্তরূপে তাঁহাদের ধর্ম হইতে প্রচ্যুত করিয়া খ্রীষ্টান করিবার যত্ন নানা প্রকারে করিতেছেন।... যদ্যপিও যিশুখ্রীষ্টের শিষ্যেরা সধৰ্ম সংস্থাপনের নিমিত্ত নানা দেশে আপন ধর্মের উৎকর্যের উপদেশ করিয়াছেন কিন্তু ইহা জানা কর্তব্য যে সে সকল দেশ তাহাদের অধিকারে ছিল না সেইরূপ মিশনারীরা ইংরেজের অনধিকারের রাজ্যে যেমন তুরকি ও পারসিয়া প্রভৃতি দেশে যাহা ইংলণ্ডের নিকট হয় এরূপ ধৰ্ম উপদেশ ও পুস্তক প্রদান যদি করেন তবে ধর্মার্থে নির্ভয় ও আপন আচার্যের যথার্থ অনুগামীরূপে প্রসিদ্ধ হইতে পারেন……
কমা, সেমিকোলন প্রভৃতি উপযুক্ত
বিরাম চিহ্ন দিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে ভাষার
পদবিন্যাসরীতি রামমোহন অনেকটা আয়ত্ত করেছিলেন।
একটি ঐতিহাসিক সমস্যা
রামমোহন
রায়কে বাংলা গদ্যের জনক বলে অনেকে অভিহিত করে থাকেন। এই অভিমতের যাথার্থ্য বিচার করা দরকার। বাংলা
সাহিত্যিক গদ্যের ভিত্তি স্থাপনে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতদের দান
অবশ্যস্বীকার্য। এঁরা সকলেই রামমোহনের পূর্ববর্তী। এঁদের অনেকের তুলনায় রামমোহনের ভাষারীতি উন্নত। বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্য ও
গৌরবের দিক থেকে অবশ্য রামমোহন পূর্ববর্তী এবং সমকালীন গদ্যলেখকদের অনেকটা
ছাড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার তাঁর বহু পূর্বেই বাংলা
গদ্যকে সাহিত্যরূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। সাধু ও চলিত ভাষা নিয়ে তিনি পরীক্ষা
করেছেন। তাঁর গদ্য রামমোহন রায়ের তুলনায় অগ্রবর্তী।
সমকালীন লেখকদের মধ্যে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর
নকশাগুলিতেও কিছু সাহিত্যগুণ-সমন্বিত গদ্য ব্যবহার করেছেন। রামমোহনের গদ্যের একটি
প্রধান ত্রুটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী,
তাঁহার অবলম্বিত রীতি যে বঙ্গ সাহিত্যে গ্রাহ্য হয় নাই তাহার প্রধান কারণ, তিনি সংস্কৃত শাস্ত্রের ভাষ্যকারদিগের রচনা পদ্ধতি অনুসরণ করিয়াছিলেন। এ গদ্য, আমরা যাহাকে modern prose বলি, তাহা নয়। পদে পদে পূর্বপক্ষকে প্রদক্ষিণ করিয়া অগ্রসর হওয়া আধুনিক গদ্যের প্রকৃতি নয়।'
রামমোহনের
গদ্যের আর একটা বড় দুর্বলতা হল ইংরেজি কমপ্লেক্স বাক্যের অনুসরণে
বাংলা বাক্যের কাঠামো গড়ে তোলা।
তাই রামমোহনকে বাংলা গদ্যের উল্লেখযোগ্য লেখক এবং প্রথম প্রাবন্ধিক বলে অভিনন্দিত করলেও, জনক বলে অভিহিত করা চলে না।
----------------------------------------------
সাহায্য
: ক্ষেত্রগুপ্ত
----------------------------------------------